মুহাম্মদ আবদুল কাহহার::
ইফতার পূর্ব মুহূর্ত মাহে রমাদানের একটি বরকতময় সময়। সাওমপালনকারী ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, দান-খয়রাত, দুয়া-মুনাজাত ছাড়াও অন্যান্য নফল ইবাদাত আদায় করার মধ্য দিয়ে সময়টি অতিবাহিত করেন। কেউ আবার নিজ হাতে ইফতার তৈরী করে থাকেন। আবার কেউ ইফতারি ক্রয় ও বিতরণে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। ব্যক্তি বিশেষে কাজের পার্থক্য হয়ে থাকে। বিশুদ্ধ হাদিসের ভাষ্যনুযায়ী ইফতারের পূর্ব মুহূর্তটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দু’য়া কবুলের যতগুলো সময় রয়েছে তার মধ্যে এটি একটি। এছাড়া একজন রোজাদারকে ইফতার করানোর মাধ্যমেও অসংখ্য নেকী অর্জন করার ব্যবস্থা রয়েছে। ‘যে ব্যক্তি একজন রোজাদারকে ইফতার করাবে তার জন্য সেই রোজাদারদের মতোই সওয়াব লেখা হবে তাতে মূল রোজাদারের সওয়াবের কমতি হবে না।’ এ হাদীসকে সামনে রেখেই ইফতার মাহফিলের আয়োজন করত ইফতারের আয়োজন করা হয়। কুরআন ও হাদিসের আলোচনা পেশ করা হয়। কিন্তু এমন একটি ভাল কাজও আজ বিতর্কীত হয়ে যেতে পারে। যেমন-‘ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো চাঙ্গা’; ‘এবার জমবে ইফতার রাজনীতি’; ‘রাজেৈনতিক দলগুলোর ইফতার পলিটিক্স’; ‘ইফতার মাহফিলে সংঘর্ষ আহত ২০’। এমন শিরোনামে প্রতি রমাদানেই সংবাদ ছাপা হয়। এ ধরণের শিরোনামের কারণে মানুষের মাঝে ইফতার মাহফিল সম্পর্কে একটি ভুল ধারণাও বিস্তার লাভ করছে।
ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু ধরণের কর্মকান্ডই বিদ্যমান। ইতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে কুরআন তেলাওয়াত, হামদে বারী তায়ালা ও নাতে রাসূল পরিবেশন, কুরআনুল কারীম থেকে পঠিত আয়াতের অনুবাদ, তাফসীর, হাদীসের উদ্বৃতি, মাহে রমাদান সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা, সীরাত ও সাহাবিদের জীবন ও কর্ম আলোচনার পাশাপাশি সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা, মুসলিমদের মধ্যে মতানৈক্যের ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহ্বানসহ তাহলিল, তাসবীহ, দুয়া ও মুনাজাত শেষে ইফতারী বন্টন করা হয়। তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। এ কাজগুলো যদি সুন্নাহ অনুসরণ করে করা হয় তাহলে সেই ধরণের ইফতার মাহফিল নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। তবে ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে কোথাও কোথাও কতিপয় নেতিবাচক কর্মকান্ডের কথাও জানা যায়। বিশেষ করে ইফতার মাহফিলের নামে শুধুই দুনিয়াবি কথা-বার্তা, ¯্রফে রাজনৈতিক বক্তৃতা, রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও দলীয় কর্মসূচি ঘোষণা, অসত্য বক্তব্য ও উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান, অপরকে খাটো করে কথা বলার মানসিকতায় পূর্ণ কথা বার্তা, গিবত, মিথ্যা গল্প তৈরী, নিজে থেকে বানিয়ে বানিয়ে বলার অপসংস্কৃতিও সমাজে চালু আছে। তাছাড়া বসার স্থান ও ইফতারি ভাগ ভাটোয়ারা, আধিপত্য বিস্তার নিয়েও দ্বন্দ্ব, হামলা, ভাংচুর, সংঘাত, সংঘর্ষ ইত্যাদি আচরণও কোথাও কোথাও দেখা যায়। এসব কর্মকান্ড শুধু বর্জনীয় নয়, একই সাথে তা নিন্দনীয়।
ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে অনেক ভাল ভাল করাজ করা হলেও মনের অজান্তেই নেতিবাচক চিন্তাগুলাই মাথায় ভর করছে। আর কেনই বা করবে না? যখন ইফতার মাহফিলের প্রধান অতিথি বা সভাপতি থাকেন গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, নাস্তিক, মুরতাদ, হিন্দু কিংবা অমুসলিম অথবা দাইয়ূস কোন মহিলা। এখানেই শেষ নয়, ‘আমি হিন্দুও নই, মুসলমানও নই’ এমন কথা যারা বলেছেন তাদেরকেও আবার ইফতার মাহফিলের অতিথি হতেও দেখা যায়। নাস্তিক আর আস্তিক কিংবা নারী-পুরুষ, বয়েেফ্রন্ড-গার্লফ্রেন্ডস একত্রিত হয়ে পর্দার বিধানসহ ইসলামের বিধি-বিধানকে উপেক্ষা করে ধর্মীয় সাইনবোর্ড ঝুলান তখন সে ধরণের ইফতার মাহফিল সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা আসবে এটাই যুক্তিযুক্ত। আর এসব কর্ম কান্ডের মাধ্যমে সাওয়াব ও হেদায়াত লাভের আশা করা অর্থহীন। এ ধরণের ইফতার মাহফিলই নয় যে কোন কাজ মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। নারী ও পুরুষদের জন্য পৃথক পৃথক ব্যবস্থা থাকা অবশ্যই জরুরী। ইতিবাচক কাজগুলো নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে, অপরদিকে নেতিবাচক কাজগুলো অবশ্যই পরিত্যাজ্য ও জঘন্য অপরাধ। ইফতার মাহফিল তখনই সফল হবে যখন তা কুরআন ও হাদীসের বিধান মেনে করা হবে। কেউ যদি নেতিবাচক কাজের জন্য ‘ইফতার মাহফিল’ নাম ব্যবহার করেন তাহলে তিনি গোনাহগার হবেন। দুনিয়ার মানুষের কাছে তারা যেমন তিরস্কারের পাত্র হবেন তেমনি পরকালে তাদের জন্য থাকবে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা।
কেউ কেউ বলেন রাজনীতিও ধর্মের বাইরে নয়। এটাও ঠিক। তবে সে রাজনীতির লক্ষ্য হবে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের জন্য রাজনীতি। আর সেই রাজনীতি করছেন নবী-রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামগণ। রাসূল স. যে নীতি ও আদর্শ রেখে গেছেন তা যথাযথ অনুসরণ করার মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করার মানসিকতা বা দেশ পরিচালনা করাই হবে আসল রাজনীতি। তখন সেটিই হবে নীতির রাজা। কিন্তু রাজনীতি যখন রাজার নীতি হয় তখন মানুষ হয় বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট। তাই রাসূল (স.) ও খোলাফায়ে রাশেদুনের দেখানো রাজনীতি করা হলে তা হবে সহীহ ও ন্যায় সঙ্গত। সব কিছুকে রাজনীতিকরণ ভাল নয় একথা যেমন সত্য, তেমনি প্রকৃত রাজনীতি করার প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে, এটিও আড়াল করে রাখা ঠিক নয়। আমরা দেখছি, পেশাদার রাজনীতিবিদদের অধিকাংশই ইফতার মাহফিলের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতকে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে ব্যবহার করেন। স্বাভাবিক রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করতে না পেরে ধর্মীয় চেতনায় রাজনৈতেক ফায়দা লাভ করতে ইফতার মাহফিল করা হলে প্রাথমিকভাবে এতটুকু বলা যায় যে তাদের নিয়ত সহীহ নয়। আর কোনো আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণীয় হওয়ার জন্য নিয়ত বিশুদ্ধ হতে হয়। তা না হলে কোন ধরণের সওয়াব আশা করা যায় না। একদল তার নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করবেন আর অন্যদলের নেতাকর্মীরা ঘনিষ্ঠতা লাভ করবেন এই যদি হয় তাদের নিয়ত তাহলে তারা ভুলের চর্চা করছেন এবং ভুলের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
ইফতার পার্টির নামে ভূরিভোজ সমাজে চালু রয়েছে তাতে অধিক পরিমাণে খাদ্যের অপচয় হয়। অভিজাত এলাকায় অহরহ খাবার অপচয় করা হয়। খাবার অপচয় করা যেন ফ্যাশনে রুপ নিয়েছে। খাদ্য অপচয় রোধে নৈতিকবোধ যত দিনে জাগ্রত না হবে ততদিনে সামগ্রিকভাবে ক্ষুধা ও দারিদ্রতা থেকে মুক্তি মিলবে না। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সংযমী হওয়ার পরিবর্তে আমরা অহংকারী আচরণ করছি। প্রতিপক্ষের আয়োজন কেমন ছিলো তা বিবেচনায় নিয়ে নিজেদেরেকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে আমরা মরিয়া হয়ে উঠছি। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষেরা প্রতি নিয়ত না খেয়ে মরছে, সঠিকভাবে খাবার পায় না। আর প্রভাবশালীরা অসৎ উপায়ে অর্জিত সম্পদ দিয়ে রাজনৈতিকভাবে ইফতারের আয়োজন করেই মনে করছেন তিনি অনেক বড় একটি ভালো কাজ করে ফেলেছেন। আলেম, এতিম, পেশাজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, বিচারপতি, সরকারি কর্মকর্তা, আত্মীয়স্বজন, জোটের শীর্ষ নেতা, কূটনীতিক, বিভিন্ন শ্রেণি পেশার নাগরিকদের সম্মানে ইফতার মাহফিল করা হলেও সাধারণ নাগরিক কিংবা প্রকৃত অভাবী ও সাওমপালনকারীদেরকে মূল্যায়ন করা হয় না। তাদের বেলায় ব্যাপক কোন আয়োজন তেমন চোখে পড়ে না। তাই এ ধরণের আয়োজনের নিয়তের বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন আসে।
আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে নিয়ে ইফতার মাহফিল আয়োজন করে ইসলামী আলোচনার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সেই কার্যক্রমকে আরো শক্তিশালী করা ঈমানের দাবী। আলোচনার মাধ্যমে একটি বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করা যায়। রাসূল (স.) ইফতারির মহত্ম্য তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, কিছু না থাকলে অর্ধেক খেজুর অথবা পানি দিয়ে হলেও সাওমপালনকারীকে ইফতার করাতে বলেছেন। রাসূলুল্লাহ সা. অন্যত্র বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে, তা তার জন্য গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে এবং সে রোজাদারের সমান সওয়াবের অংশীদার হবে। অথচ রোজাদারের সাওয়াবের মধ্যে কোনো কম করা হবে না। ’ এছাড়াও বলা হয়েছে,‘ যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে পানি পান করাবে আল্লাহ তাকে হাউসে কাওসার থেকে এমন পানি পান করাবেন, যারপর জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত আর পিপাসা লাগবে না। ’(বায়হাকি, ইবনে খুজায়মা)। তাই নিজেদের ইফতারি পরস্পর ভাগাভাগি করে খাওয়ার মধ্য দিয়ে, অপর ভাইকে ইফতারে শামিল করে চরম তৃপ্তি, অধিক পূণ্য ও কল্যাণ করা যায়। তাই সহীহ নিয়ত নিয়ে ইফতার মাহফিলের আয়োজন বেশি বেশি করা উচিত।
সর্বোপরি, দুনিয়ার ফায়দা হাসিলের জন্য ধর্মীয় ব্যানারে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালানোর যে রীতি চালু হয়েছে তা বন্ধ হওয়া দরকার। নিয়তকে বিশুদ্ধ করতে হবে। ইবাদত যাতে বিতর্কীত না হয় সে জন্য সতর্কতার সাথে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করতে হবে। বিশেষ করে প্রত্যেকের সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে যাতে তাকওয়া অর্জিত হয় সে ভাবেই সাওম পালন করা উচিত। আর তাকওয়া অর্জনের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সকল আদেশ মানা ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট
পাঠকের মতামত